পড়াশোনার জন্য যারা মা-বাবা ছেড়ে দূরে আছেন লেখাটি তাদেরকে উৎসর্গ করলাম

.
ঘন কুয়াশা মাখা তীব্র শীতের সকাল। আমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই বাবা নিজ হাতে গাছ থেকে ডাব পেরেছেন। গাছের কুলগুলো (বরই) এখনো খাওয়ার উপযুক্ত হয়নি, তবুও বেছে বেছে বেশ কয়েকটি আমার জন্য পেরে এনেছেন। পরবর্তী ছুটিতে এসে যে আর পাবোনা এটা বাবা ভালোভাবেই জানেন। মা আজ সকাল সকাল রান্না শুরু করেছেন। ইতোমধ্যেই পাশের বাড়ির ভাবি তার ফ্রিজে জমিয়ে রাখা বেশ কিছু খাবার আমার জন্য দিয়ে গেছে। আর কে কী দিয়েছে তা অবশ্য আমার চোখে পড়েনি। তবে খেতে বসে খাবারের আইটেম দেখেই আমার চোখ কপালে ওঠে। মাছ, মাংস, সবজি, ডিম, দুধ আর যাই বলিনা কেনো, কী নেই সেখানে! যেনো রাজ্যের সমস্ত খাবার আমার সামনে! কোনটা রাখবো আর কোনটা খাবো এটা নির্ধারণ করাই আমার জন্য কঠিন হয়ে যায়। তবে মায়ের রান্না করা এতগুলো খাবারের আইটেম একসাথে দেখে বড় আফসোসই লাগে। ইশ, এরকম খাবার যদি সারাবছরই পেতাম, অন্তত ক্যাম্পাসের বান্ধবীগুলো আমার শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলার সুযোগ পেতনা! নাহ, এগুলো শুধুই খাবার না, এগুলো মায়ের ভালবাসা। এগুলোকে শুধু খাবার বলে চালিয়ে দিলে মায়ের সাথে বড় বেইমানী করা হবে!
.
অতঃপর বিদায়ের মুহূর্তে মায়ের সেই কমন উক্তি "আর দুটো দিন বেশি থাকলে কী এমন ক্ষতি হতো"! উল্লেখ্য যে, বাড়িতে যদি এক সপ্তাহ, পনের দিন কিংবা এক মাসের ছুটিতেও আসি, মা প্রতিবারই যাওয়ার সময় আরো দুই দিন বেশি থাকার কথা বলেন। হয়তো সন্তানের প্রতি ভালবাসার কারণেই! বাবা এ সময় মা-ছেলের কথোপকথনের নির্বাক সাক্ষী। তার মনটাও যে বিদায় দিতে চাচ্ছেনা তা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। "দেখেশুনে যেও আর ভালোভাবে থেকো" বাবা এ কথা বলার পরই মায়ের টলমলে চোখদুটো এবার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। তবু যেতে হয়, মাকে ব্যর্থ সান্ত্বনা দিয়েই। মা আঁচলে চোখ মুছতে থাকে আর তাকিয়ে থাকে আমার যাওয়ার রাস্তায়, যতদূর দেখা যায়!
.
পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হেঁটে চলি গ্রামের মেঠোপথ ধরে। স্কুল মাঠ পর্যন্ত গেলেই ভ্যানের দেখা মিলবে। তবে এ পথটুকু অতিক্রম করাটাই আমার পক্ষে অনেক কঠিন হয়ে যায়। চলতি পথে যার সাথে দেখা হয় তার থেকেই বিদায় নিতে হয়। বিদায় নেয়াটা আসলেই অনেক কঠিন! পিছনে ব্যাগ দেখে দূর থেকেই সমবয়সী ছেলেটা বলে ওঠে "চলেই যাচ্ছ? তাহলে তো আর ব্যাডমিন্টন খেলা হবেনা"! আমি কী জবাব দিবো তা ভেবে পাইনা। শুধু দূর হতেই হাত নাড়িয়ে ইশারায় কিছু বুঝানোর চেষ্টা করি।
একটু সামনে মোড়ের কাছেই দোকান। দোকানের ক্যারাম বোর্ডে চারজন খেলায় ব্যস্ত। ওরা আমায় দেখেই খেলা থামিয়ে দেয়। "চলে যাচ্ছি, ভালো থেকো সবাই" আমার কথা শুনে একজন জিজ্ঞেস করে, আবার কবে আসবা? আমি উত্তর দেই "চার মাস পর"। এবার ওরা কিছু বলতে পারেনা, শুধু নির্বাক দৃষ্টিতে আমার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে!
.
স্কুল মাঠ পেরিয়ে ভ্যান এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। আস্তে আস্তে পিছনে পরে যাচ্ছে গ্রামের প্রতিটি পরিচিত মানুষ, প্রতিটি বাড়িঘর। আমি বারবার পিছনে ফিরে তাকাই আমার জন্মভূমি প্রিয় গ্রামের দিকে, যার প্রতিটি ধূলিকণায় মিশে আছে আমার শৈশব-কৈশোরের দূরান্তপনা। আস্তে আস্তে একসময় গ্রামটি চোখের দৃষ্টি হতে দূরে মিলে যায়। সাথে সাথে আমার যানবাহনেরও পরিবর্তন হয়। ভ্যান হতে সিএনজি, অতঃপর বাসযোগে শুরু হয় বগুড়া টু রাজশাহী যাত্রা। এ যাত্রাপথে আমার সময় কাটানোর সঙ্গী হাতের স্মার্টফোন ও হেডফোন। কখনো ফেসবুক চালাই, কখনো গান শুনি কিংবা কখনো বামপাশের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকি দূর-দিগন্তে। আমার চোখের সামনে শুধু যেনো দুটি মুখের ছবিই বারবার ভাসে। একটি কনকনে শীতের সকালে গাছ থেকে ডাব পেরে আনা বাবার, আরেকটি বিদায়বেলায় অশ্রুসিক্ত মায়ের মুখের ছবি। এই ছবিদুটির কথা ভাবলে আমার মাথায় যেনো আর অন্য কোনো চিন্তাভাবনা কাজ করেনা। শুধু মনে হয় অন্তত এই দুটি মানুষের জন্য হলেও আমাকে জীবনে কিছু করতে হবে। আর সে লক্ষ্যেই ছুটে চলি প্রাণের ক্যাম্পাসে। ভালো থাকুক প্রিয় জন্মভূমি আর প্রিয় মানুষগুলো।

Total Pageviews