মানব দেহে হরমোনের তাতপর্য

মানুষের দেহের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি রাসায়নিক উপাদান হরমোন। দেহের ভাঙ্গা-গড়াসহ সমগ্র বিপাকীয় ক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকরে এই হরমোন। হরমোনের অভাব বা আধিক্য দু’টো কারণের যে কোনোটাই দেহে ডেকে আনতে পারে মারাত্মক অসুখ-বিসুখ।এ সব অসুখ বিসুখ নিয়ে কথা বলার আগে বরং আমরা জেনে নেই হরমোন কি এবং মানব দেহে কি ভূমিকা পালন করে। অর্থাত মানব দেহে হরমোন তাতপর্য কি? হরমোন নিয়ে আলোচনা করবেন ঢাকার বারডেম হাসপাতালের হরমোন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ।রেডিও তেহরান: অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ হরমোন শব্দটি আমাদের অপরিচিত নয়। তবে হরমোন বলতে কি বোঝান হয় সে কথা আমাদের একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ: হরমোন আসলে একটি ইংরেজি শব্দ। এর মূল শব্দটি গ্রীক। শব্দগত অর্থ হচ্ছে আই এক্সাইট। হরমোন হলো আসলে একধরনের ‘substance’ বা উপাদান যেটা আমাদের শরীরের বিশেষ ধরনের কোষ তৈরী করে। আর এই উপাদান সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে যায় রক্তের মাধ্যমে। এর মূল কাজ হচ্ছে- দেহের সমস্ত কোষের যে কার্যপ্রণালী আছে তাদের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য বিধান করা বা রেগুলেশন করা।মোট কথা হচ্ছে হরমোনকে এভাবে বলা যায়, মানুষ বা অন্য যে কোনো বহুকোষী প্রাণীর কোষগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা, কর্মকাণ্ডের একটা ক্রোনোলজি বা অর্থপূর্ণ কর্মকাণ্ড করার জন্য একটা কন্ট্রোলিং সিস্টেম।রেডিও তেহরান: অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ ,হরমোন দেহের এক জাতের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সে বিষয়টি বুঝতে পারলান এখন আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, দেহে আর কোনো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কি আছে?অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ: শরীরে আরেকটা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আছে যাকে আমরা নার্ভাস সিস্টেম বলি। ব্রেন এবং স্নায়ুতন্ত্র দিয়ে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ করা হয়। স্নায়ুতন্ত্র দিয়ে যে নিয়ন্ত্রণ করা হয় সেটি ইমিডিয়েট কন্ট্রোল। আরস্থায়ীভাবে এবং ধীরে ধীরে সমস্ত শরীরের কার্যক্রমকে যেটা কন্ট্রোল করে সেটি হচ্ছে ‘হরমোন সিস্টেম’।রেডিও তেহরান: অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ , স্নায়ু এবং হরমোন দেহের দু’টিনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। স্নায়ু তাতক্ষণিক নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে আর হরমোন দিয়ে দেহের দীর্ঘমেয়াদি নিয়ন্ত্রণ করা হয় সে কথা সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এবারে আমাদের প্রশ্ন হলো, দেহে কয় ধরণের হরমোন আছে?অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ: হরমোনকে তারকাজের ভিত্তিতে যদি আমরা মোটামুটিভাবে ভাগ করি তাহলে দেখা যাবে চার ধরনের হরমোন রয়েছে।একধরনের হরমোন আছে যারা আমাদের দেহেরবৃদ্ধির ঘটক, ইংরেজিতে যাকে বলে গ্রোথএবং ডেভলাপমেন্টের কাজ করে থাকে।আরেক ধরনের হরমোন আছে যারা আমদের দেহের কোষগুলোর অর্থাত দেহের সামগ্রিক শক্তি উতপাদন, শক্তির ব্যবহার- অর্থাত এনার্জি এবং মেটাবলিজম কন্ট্রোলের জন্য কাজ করে।আরেক ধরনের হরমোন আছে যার কাজ হচ্ছে- শরীরের ভেতরে যে পানি আছে, ইলেকট্রোলাইজড আছে অর্থাত ইন্টারনালইনভায়রনমেন্টকে সে মেইনটেইন করে।হরমোনের আরেকধরনের কার্যক্রম আছে। সেটি হচ্ছে সেক্স হরমোন। অর্থাত এই হরমোনের মাধ্যমে রিপ্রোডাকশন ততপরতাচালানো হয় এবং পুরুষ ও মহিলাকে স্বাতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দিয়ে থাকে এ হরমোন।রেডিও তেহরান: অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ হরমোনকে এ ছাড়া আর কোনো ভাবে ভাগ করা যায় কি?অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ: জ্বি আবার অন্য দৃষ্টিভঙ্গীতেও হরমোনগুলোকে ভাগ করা যায়। যেহেতু হরমোনগুলো বিশেষ কোষ থেকে তৈরী- এই কোষগুলো আবার গ্রন্থিআকারে আমাদের শরীরের বিভিন্নঅংশে থাকে। যে গ্রন্থি থেকে হরমোনগুলো তৈরী হয় সেই গ্রন্থির নামানুসারে হরমোনগুলোর নাম দেয়া হয়। যেমন আমরা thyroid গ্রন্থি থেকে যদি হরমোন পাই তাহলে সেগুলোকে একত্রেবলি thyroid হরমোন। এড্রেনাল কটেক্স বলে দুটো গ্লান্ড আছে শরীরের কিডনির দুই পাশে। এদের থেকে আমরা বিভিন্ন ধরনের হরমোন পেয়ে থাকি। এগুলোকে একত্রে বলে থাকি ‘adrenal hormones’। adrenal medulla আরেকটা অংশ আছে। সেখান থেকে যে হরমোনগুলো আমরা পাই সেটাকে adrenal medulla hormones বলে থাকি। ‘pituitary gland’ বা পিটুইটারি নামক যে গ্রন্থি সেটি মূলত আমাদের মস্তিষ্কের নিচে থাকে- এটিও অনেকগুলোহরমোন তৈরী করে থাকে। আর সেগুলোকে একত্রে আমরা বলে থাকি- pituitary hormones. এভাবে হরমোনগুলোকে ভাগ করা যায়।আমি প্রথমে বললাম যে হরমোনের মৌলিক কর্মকাণ্ডের ওপর শ্রেণীভাগ করা যায়। আবার তাদের বেসিক কাজের ভিত্তিতেও ভাগ করা যায়। যেমন আমরা একটা হরমোনের কথা প্রায়াই শুনি সেটিহচ্ছে গ্রোথ হরমোন। গ্রোথ হরমোনটা পিটুইটারি গ্রন্থির একটা হরমোন। যার কাজ হচ্ছে একটা মানুষ বা একটা প্রাণীর গ্রোথ বা বৃদ্ধির কাজ করে থাকে। এটা যদি স্বাভাবিকভাবে কাজ করেতাহলে আমাদের গ্রোথ অর্থাত উচ্চতা, ওজন এবং দৈহিক গঠন ইত্যাদি স্বাভাবিকহবে। যদি এই হরমোনগুলো ছোটবেলা থেকে বেশি থাকে তাহলে একটা মানুষ ভীষণভাবেলম্বা হয়ে যেতে পারে। সেটাকে আমরা বলি যে gigantism , জায়ান্ট বা দৈত্যেরমতো।আবার যদি এই হরমোনটাই কারো ক্ষেত্রে স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকে তাহলে তারউচ্চতা বাড়বে না। দেখতে খুবই ছোট থাকবে, বামন থাকবে। এগুলো আমরা বলি pituitary short stature. কারো যদি থায়োরয়েড হরমোন স্বাভাবিক থাকে তার এ্যাক্টিভিটি স্বাভাবিক থাকবে। কিন্তু এই হরমোন যদি কমে যায় তাহলে তার বৃদ্ধি হবে না। যদি ছোট বেলায় এটি হয় তাহলে তার মানসিক এবং দৈহিক বৃদ্ধি ঘটবে না। আর বয়স্কদের হলে তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড স্লো হয়ে যাবে। তখন তারা ঠিকমতো কাজ-কর্ম করতে পারবেন না। খকথাটা এভাবেও বলা যায় হরমোনগুলো স্বাভাবিক থাকলে আমরা স্বাভাবিক আর স্বাভাবিক না থাকলে অর্থাত বেশি হলে আমরা তাকে অসুস্থ বলব আবার কম থাকলেও তাকে অসুস্থ বলব।রেডিও তেহরান: অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ হরমোন কম থাকলেও আমরা অসুখ ভুগি বা বেশি থাকলেও অসুখে ভুগি। হরমোন কম থাকলেও অসুখ হয় এবং বেশি থাকলেও অসুখ হয়। এখন সামগ্রিক ভাবে আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য হরমোনের তাতপর্য কি?অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ: সামগ্রিকভাবে আমরা যদি হরমোনের কথা বলি এবং স্বাস্থ্যের জন্য হরমোনের তাতপর্যের কথা বলি- তাহলে এভাবে বলা যায়- হরমোন স্বাভাবিক থাকলে আমরা স্বাভাবিক আর যদি তাদের ঘাটতি থাকে তাহলে আমরা ঘাটতিজনিত অসুস্থতায় ভুগি আর বাড়তি হলেও বাড়তিজনিত অসুস্থতায় ভুগি।আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে হরমোনের ঘাটতি বা বাড়তি যখন হয় তখন তার জন্যে যেসব রোগ হয় সেগুলো হয় জীবনব্যাপী। যেমন ধরুন ডায়াবেটিস একবার হলো ইনসুলিনের ঘাটতির জন্য তাকে সারাজীবন ডায়াবেটিসে ভুগতে হবে। ধরুন একজনের পিটুইটারি গ্লান্ড কাজ করছে না ফলে তার অনেকগুলো হরমোন একসাথে কমে গেলো ফলে বাইরে থেকে এসব হরমোন সারা জীবন সরবরাহ করে এর অভাব পূরণ করতে হবে। সামগ্রিকভাবে যদি এবিষয়গুলোর দিকে আমরা একটু নজর দেই তাহলে দেহের যে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড বজায় রাখার জন্য স্বাভাবিক হরমোনাল অ্যাক্টিভিটির দিকে লক্ষ্য রাখব। কম হলে বা বেশি হলে আমরা অসুস্থ হয়ে যাই। অবশ্য দেহে হরমোন কম বা বেশি হলে তার চিকিতসা করে আমরা স্বাভাবিক থাকতে পারি।

Total Pageviews