পৃথিবীতে মহাদেশ সাতটি—অনেকেই এটা জানেন। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাঁরা এমন এক বিস্তৃত এলাকার সন্ধান পেয়েছেন, যেটি অষ্টম মহাদেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য।
বিজ্ঞানীদের সন্ধান পাওয়া নতুন এই বিস্তৃত এলাকা লুকিয়ে আছে দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের নিচে! নিউজিল্যান্ড এই মহাদেশের পানির ওপরে থাকা একমাত্র অংশ। বাকি সবটুকু পানির নিচে। এ কারণেই বিজ্ঞানীরা এই ‘মহাদেশ’টির নাম দিয়েছেন জিল্যান্ডিয়া। আকারে এটি ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় সমান।
মর্টিমার ও ক্যাম্পবেল চেষ্টা করেছেন তাঁদের গবেষণার মাধ্যমে জিল্যান্ডিয়ার সম্ভাব্য একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র কল্পনা করার, পানির নিচে নিমজ্জিত না থাকলে জেমস কুকের সামনেও যেটি দৃশ্যমান হতো। তাঁদের মতে, জিল্যান্ডিয়া দৈর্ঘ্যে মোট ৪০০০ কিলোমিটার লম্বা, এবং আয়তনে আজকের দিনের নিউজিল্যান্ডের চেয়ে ১৭ গুণ বড়। এছাড়া জিল্যান্ডিয়ার মানচিত্র তৈরি করা হলে সেটিকে অনেকেই বৃহদাকৃতির ব্রিটেন বলে চিহ্নিত করেছেন।
মজার ব্যাপার হলো, জিল্যান্ডিয়াকে ব্রিটেনের সম্প্রসারিত সংস্করণ হিসেবে মনে করার এই প্রবণতা কিন্তু খুব হালনাগাদ কোনো ঘটনা নয়। সেই ১৮৫৭ সালেই নিউজিল্যান্ডের এক প্রথম দিককার ঔপনিবেশিক, চার্লস হার্স্টহাউজ একটি বই লিখেছিলেন, যার শিরোনাম ছিল New Zealand or Zealandia, the Britain of the South. নাম শুনেই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, তিনি এটিকে দক্ষিণের ব্রিটেন হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।
হার্স্টহাউজ কোনো বিজ্ঞানী ছিলেন না। তাছাড়া তিনি যখন বইটি লিখেছিলেন, তখনো কোনো প্রকার ভৌগোলিক জরিপও শুরু হয়নি। তারপরও বিস্ময়করভাবে তিনি তাঁর বইটিতে লিখেছিলেন,
"নিউজিল্যান্ডের ভূপ্রকৃতি থেকে এই তত্ত্বকে নির্দেশ করে যে এটি মূলত অনেক বড় কোনো মহাদেশের একটি অংশ, যেটি দীর্ঘসময় পূর্বে পানিতে নিমজ্জিত হয়ে গেছে।"
অর্থাৎ জিল্যান্ডিয়া যে পানির নিচে নিমজ্জিত একটি বিশাল মহাদেশ হতে পারে, সে সম্ভাবনাও খুব সাম্প্রতিক কিছু নয়। অন্তত উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়কাল থেকেই মানুষের মনে এ ধারণাটি বদ্ধমূল হতে শুরু করেছিল, এবং স্থানীয়ভাবে সবসময়ই জিল্যান্ডিয়াকে একটি মহাদেশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবি উঠে আসছিল। সেই দাবির পালে নতুন করে হাওয়া লাগে ১৯৬০'র দশকে, যখন সমুদ্রের তলদেশে তেলের সন্ধান করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা স্বচক্ষে আবিষ্কার করেন এই মহাদেশের অস্তিত্ব।
জিল্যান্ডিয়া নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে আরো একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বছর ১৯৯৫ সাল, যখন আমেরিকান ভূপ্রকৃতিবিদ ব্রুস লুয়েনডিক জিল্যান্ডিয়া নামটিকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করেন, এবং এটিকে পৃথিবীর সম্ভাব্য অষ্টম মহাদেশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের মডেল দাঁড় করান।
লুয়েনডিক অবশ্য জিল্যান্ডিয়ার মহাদেশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভের ক্ষেত্রে চারটির মধ্যে তিনটি শর্ত পূরণকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। সুনির্দিষ্ট সীমারেখার শর্তটি সেখানে ছিল অনুপস্থিত। তারপরও তখন থেকেই ভূবিজ্ঞানীরা নতুন উদ্যমে জিল্যান্ডিয়া নিয়ে গবেষণা শুরু করেন বাকি একটি শর্ত পূরণের নিমিত্তে, এবং সেই দীর্ঘ পথচলার একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ হলো মর্টিমার ও ক্যাম্পবেলের গবেষণাটি।
২০০২ সালে ব্যাথিমেট্রিক মানচিত্র প্রণয়নের মাধ্যমে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা, এবং শেষ পর্যন্ত স্যাটেলাইট প্রযুক্তি এবং সমুদ্রেপৃষ্ঠের মাধ্যাকর্ষণ মানচিত্রের মাধ্যমে তাঁরা সফলভাবে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে জিল্যান্ডিয়া একটি বিশাল অঞ্চলজুড়ে ব্যাপ্ত, সমন্বিত ভূখণ্ডও বটে।
বৈজ্ঞানিকভাবে না হয় প্রমাণ করা গেছে যে জিল্যান্ডিয়া একটি মহাদেশ, কিন্তু পাঠ্যপুস্তকে কি এটিকে একটি পৃথক মহাদেশ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে? না, এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী খুব কম দেশের পাঠ্যপুস্তকেই মহাদেশ হিসেবে জিল্যান্ডিয়ার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন, হয়তো পাঠ্যপুস্তক রচয়িতারা কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির জন্য অপেক্ষা করে আছেন। কিন্তু বাস্তবে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ভূখণ্ডকে মহাদেশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য কোনো আন্তর্জাতিক ফোরাম বা সংস্থারই অস্তিত্ব নেই। তাই জিল্যান্ডিয়া পৃথিবীর অষ্টম মহাদেশ কি না, সেটি কোনো ফোরামের ঘোষণার উপর নির্ভরশীল নয়। বরং এটিকে সময়ের উপরই ছেড়ে দিতে হবে।
ভবিষ্যতে হয়তো জিল্যান্ডিয়া নিয়ে আরো অনেক গবেষণা হতে থাকবে, যেগুলোতে একে মহাদেশ হিসেবে স্বীকার করে নেয়া হবে, এবং তার মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে বিশ্বের আরো অনেক মানুষ (বিশেষত বিজ্ঞানীরা) এটিকে মহাদেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেবেন। এভাবেই ধীরে ধীরে, জিল্যান্ডিয়া যে একটি মহাদেশ সেটি যখন সার্বজনীন জ্ঞানে পরিণত হবে, তখন হয়তো এটির নামও উঠে আসবে পাঠ্যপুস্তকের পাতায়।
অবশ্য এখানেই যে বিতর্কের সমাপ্তি ঘটবে, তা-ও কিন্তু নয়। দেখা যাবে জিল্যান্ডিয়াকে সহই অনেকে পৃথিবীর মহাদেশ সংখ্যা ধরছেন সাত। এবং এখনো তাঁরা জিল্যান্ডিয়াকে বাদ দিয়ে পৃথিবীর মহাদেশ সংখ্যা গণনা করছেন ছয়। এর কারণ, ইউরোপ ও এশিয়াকে তাঁরা পৃথক দুইটি মহাদেশ হিসেবে গণ্য করেন না। যেহেতু ইউরোপ ও এশিয়া অভিন্ন ভূখণ্ডে অবস্থিত, তাই তাঁরা এই দুই মহাদেশকে একত্রে 'ইউরেশিয়া' নামে অভিহিত করে থাকেন।