‘তোতলামি’ বা কথা বলার বিশেষ সমস্যার কারণ খুঁজতে
শত শত বছর ধরে চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা৷ কিন্তু, এই
দুর্ভোগের কোনো উৎসসূত্র পাওয়া যায়নি এতোদিন৷
সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, জিনগত ত্রুটির সঙ্গে সম্পর্ক
থাকতে পারে এর৷
‘তোতলামি করাটা এক ধরনের রোগ। এই রোগের পিছনে
অনেকগুলো কারণ চিন্তা করা হয়েছে। মানুষের কথা বলা
নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিষ্কের বেশ কয়েকটি অংশ দিয়ে।
বিভিন্ন অংশে সমস্যা হলে বিভিন্ন ধরনের কথা বলা
সংক্রান্ত রোগ হয়। তোতলামি বা স্টাটারিং-এর পিছনে
ব্রেইনের কোন অংশ কাজ করছে সেটা নিয়ে গবেষণা
হচ্ছে। কেউ বলছেন যারা তোতলায় তাদের ব্রেইনের
সামনের নিচের দিকের অংশ, যেটাকে ব্রোকাস এরিয়া
বলে এবং যেটা মানুষের কথা বলতে পারাকে প্রোগ্রাম
করে, সেটাতে ফাংশন কম হয়। আবার কেউ বলছেন 'রাইট
ফ্রণ্টাল অপারকুলাম'নামক একটা জায়গায় এবনরমাল
একটিভিটি হয়। তবে মূলত দেখা গেছে কথা বলার সময়
ব্রেইনের বিভিন্ন অংশগুলো যেই ক্রমে কাজ করে,
তোতলামোর রোগীদের সেই ক্রমটা একটু ওলটপালট হয়ে
যায়।
তোতলামি রোগটা শিশু থেকে বড় হওয়ার সময় হতে পারে।
যেগুলোকে বলে ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার। আবার
একদল বিজ্ঞানী তোতলামো রোগীদের মধ্যে তিনটে
জিনকে এর সাথে সম্পর্কিত পেয়েছেন। যদিও
স্টাটারিং রোগটার পুরোপুরি ভাল হয় না, কিন্তু কিছু
থেরাপী আছে যার মাধ্যমে এটিকে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে
নিয়ে আসা যায়’।
তোতলামি বা কথা বলার প্রতিবন্ধকতা এমন একটি
শারীরিক ব্যাধি যার কারণে কিছু মানুষ একই শব্দকে বার
বার বলে, অনেক সময় একটা শব্দকে টেনে অনেক লম্বা
করে বলতে থাকে এবং অনিচ্ছাকৃত এই সমস্যার কারণে
কথা বলার স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয়৷
‘নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন' সম্প্রতি এই
তোতলামির কারণ সংক্রান্ত এক গবেষণা প্রতিবেদন
ছেপেছে৷ জিনতত্ত্ববিদ এবং এই গবেষণা প্রতিবেদনের
অন্যতম রচয়িতা ডেনিস দ্রায়ানা তাঁদের অনুসন্ধানের
সাফল্য সম্পর্কে বার্তা সংস্থা এএফপি-কে
বলেন,‘‘তোতলামির কারণ অনুসন্ধানে হাজার বছর ধরে
নানা অনুমান করেছে মানুষ৷ অবশেষে আমরা অন্ততপক্ষে
এর কিছুটা হলেও জানতে পেরেছি”৷
যুক্তরাষ্ট্রের ‘শ্রবণ এবং অন্যান্য যোগাযোগ
প্রতিবন্ধিত্ব বিষয়ক জাতীয় ইন্সটিটিউট' বা
‘এনআইডিসিডি'-এর বিজ্ঞানীরা এই গবেষণা করেন৷ এই
ইন্সটিটিউটে দ্রায়না এবং তাঁর সহকর্মীরা যুক্তরাষ্ট্র,
ব্রিটেন এবং পাকিস্তানের প্রায় সাড়ে সাতশ মানুষের
ওপর এই গবেষণা চালান৷ এজন্য বেছে নেওয়া হয়
তোতলামি'র সমস্যা আছে এমন ১২৩ জন এবং এই সমস্যা
নেই এমন ৯৬ জন পাকিস্তানিকে৷ এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও
ব্রিটেনের ৫৫০ জন ব্যক্তিকেও বাছাই করা হয় একইভাবে৷
যাদের প্রায় অর্ধেকেরই তোতলামি'র সমস্য রয়েছে৷
এই গবেষণায় অন্তর্ভূক্ত কিছু পাকিস্তানিকে আগের এক
কাছাকাছি গবেষণাতেও বেছে নেওয়া হয়েছিল৷ আগের
ওই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছিলেন যে,
তোতলামির সমস্যা আছে এমন ব্যক্তিদের জিনে
‘জিএনপিটিএবি' নামে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে৷
নতুন গবেষণার ফলাফল বলছে ‘তোতলা' ব্যক্তিদের জিনে
‘জিএনপিটিএবি' নামক ‘মিউটেশন' তো আছেই বরং
একইসঙ্গে এমন আরও দু'টি ‘মিউটেশন' আছে৷ এগুলো হল
‘জিএনপিটিজি' এবং ‘এনএজিপিএ'৷ কিন্তু ‘তোতলা' নন
এমন ব্যক্তিদের এই তিনটির কোনো ‘জিন মিউটেশন'-ই
নেই৷
মার্কিন এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক জেমস
বেটি বলেন, ‘‘এই গবেষণাতেই প্রথমবারের মতো
তোতলামি'র সঙ্গে সম্পৃক্ত হিসেবে সুনির্দিষ্ট করে
কোনো জিন মিউটেশনকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে৷
ফলে এখন তোতলামি'রি চিকিৎসার সুযোগ নাটকীয়ভাবে
বেড়ে গেল৷''
‘স্টাটারিং ফাউন্ডেশন' এর প্রেসিডেন্ট জেন ফ্রাসের
বলেছেন, এই গবেষণার ফলে অনেক অভিভাবকের কাঁধ
থেকে একটা বোঝা নেমে গেল৷ যারা ভাবতেন যে,
তাঁদের কোনো ভুলের কারণেই সন্তান তোতলামির
সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে৷ ফ্রাসের বলেন, ‘‘গবেষণা থেকে
এটা স্পষ্ট যে সমস্যাটা শরীরবৃত্তীয়৷''
তবে, ওষুধের মাধ্যমে তোতলামির শারীরিক চিকিৎসার
এখনও অনেক পথ বাকি বলে মন্তব্য করে তিনি বলেছেন,
এখনও আগের মতোই থেরাপির মাধ্যমেই চিকিৎসা
চালিয়ে যেতে হবে৷ পাকিস্তানের লাহোরের পাঞ্জাব
ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার ‘হলিন্স
কমিউনিকেশন্স রিসার্চ ইনস্টিটিউট' এবং ‘ইউএস
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ'-ও ‘এনআইডিসিডি'র এই
গবেষণায় অংশ নিয়েছে৷
ভয়েস অব আমেরিকার প্রতিবেদক রোকেয়া হায়দার তাঁর
একটা প্রতিবেদনে তোতালামি নিয়ে মেরীল্যাণ্ড
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ন্যান র্যাটনার মুক ও বধির
সংক্রান্ত বিজ্ঞানের শিক্ষকের কথা তুলে ধরেন
এভাবে, ‘অনেকেই ব্যাপারটাকে ভুল বোঝে এবং মনে
করে যে, তোতলামি হচ্ছে আবেগ সামলানোর এক সমস্যা।
ছেলেবেলায় কোন কিছুতে ভয় পাওয়ার কারণে হয়েছে,
বা অতিরিক্ত উদ্বেগ উত্কণ্ঠা এর কারণ। আসলে কিন্তু
তা নয়’।
উপায় :
তোতলামি দূর করার তেমন কোনো নির্দিষ্ট উপায় নাই।
তারপরও কিছু মুখের ব্যায়াম রয়েছে যেগুলো অনুশীলনে
তোতলামির অভ্যাসটা কিছুটা আয়ত্তে আনা সম্ভব।
এছাড়া ধীরে ধীরে কথা বলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
সম্ভব হলে গানে গানে কথা বলার অভ্যাস গড়ে তুলতে
পারেন। এতে করে নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে বাক্যটি শেষ
করার একটা প্রবণতা তৈরি হবে। ধন্যবাদ