বলতে পারেন, রাসূল (সা.) কার কাছ থেকে নামাজ শিখেছেন? (৬ষ্ঠ পর্ব)

পাঠক! নামাজ বিশ্লেষণমূলক ধারাবাহিক এই আলোচনায় আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। যেদিন নবুয়্যতের নূর হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর পবিত্র হৃদয়ে প্রোজ্জ্বলিত হলো এবং তিনি নবুয়্যতের দায়িত্বে অভিষিক্ত হলেন, ফেরেশতাগণ সেদিন একে অপরকে অভিনন্দিত করলো আর এই মহান নিয়ামতের জন্যে আল্লাহর প্রশংসা করলো।
রাসূলে খোদা (সা.) এর উপর মানুষকে হেদায়েত করার যে গুরুদায়িত্বটি অর্পিত ছিল সেই দায়িত্ব অর্থাৎ দাওয়াতি কাজের দায়িত্ব তিনি শুরু করলেন। একদিন আল্লাহর ফেরেশতা তার কাছে এলো। নবীজী নিজেকে আল্লাহর ওহী গ্রহণের জন্যে প্রস্তুত করলেন।
ওহীর ফেরেশতা সালাম জানালেন এবং নবীজী জবাব দিলেন। জিব্রাঈল (আ.) বললেন, এসেছি আল্লাহর পয়গাম্বরকে নামাজ শেখাতে। নবীজী অতীতেও আল্লাহর ইবাদাত করতেন কিন্তু নামাজের মতো বিশেষ ইবাদাতটি গ্রহণ করে ভীষণ খুশি ও আনন্দিত হলেন। জিব্রাঈল ওজু করলো।
নবীজীও জিব্রাঈলের অনুসরণে ওজু করলেন। তারপর জিব্রাঈল নামাজ পড়ার নিয়ম-কানুন শেখালেন। অনেক রেওয়ায়েতেও এসেছে যে নবীজী যখন মেরাজে বা উর্ধ্বগমনে গিয়েছিলেন আল্লাহর সান্নিধ্যে, তখনই নামাজের প্রসঙ্গটি এসেছে এবং আল্লাহর নবী (সা) নামাজ পড়ার রীতিনীতিগুলো বর্তমান রীতিতে শিখেছেন।
সেখানে নবীজীকে বলা হয়েছিল নামাজে দাঁড়াতে। ঠিক তখন বার্তা এসেছিল- (পড়ো! বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন...। করুণাময় আল্লাহর নামে যিনি ভীষণ দয়াময়। সকল প্রশংসা বিশ্বের মহান প্রতিপালকের। নবীজী আয়াতের শেষ পর্যন্ত তিলাওয়াত করলেন। সে সময় আদেশ করা হলো রুকুতে যাওয়ার জন্যে।
মুহাম্মাদ (সা.) রুকুতে গেলেন এবং তিন বার বললেন-সুবহানা রাব্বিয়াল আজিম ও বিহামদিহী। আমার প্রতিপালক মহান এবং পূত-পবিত্র এবং তাঁরি প্রশংসা করছি। তারপর উঠে দাঁড়ালেন। তখন ফরমান এলো-হে মুহাম্মাদ! তোমার প্রতিপালকের জন্যে সিজদা করো। রাসূলে খোদা (সা.) সেদজায় গেলেন এবং তিনবার বললেন-সুবহানা রাব্বিয়াল আলা অবিহামদিহি....অর্থাৎ আমার প্রতিপালক মহান এবং পূত-পবিত্র এবং তাঁরি প্রশংসা করছি। ঘোষণা এলো-ওঠো এবং বসো। রাসূলে খোদা (সা) সেজদা থেকে তাঁর মাথা তুললেন এবং বসলেন।
এ সময় আল্লাহর সম্মান ও মর্যাদা রাসূল (সা.) কে বিনীত করে তুললো, তিনি পুনরায় সিজদায় গেলেন। এভাবেই মুসলমানদের প্রতি রাকাত নামাজের জন্যে দুটি সিজদা নির্দিষ্ট হয়।
এ ভাবেই রাসূলে খোদা (সা.) আল্লাহর আদেশে নামাজ কায়েম করলেন। মুসলিম উম্মাতের ওপর দিবারাত্র পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয়েছে। রাসূলে খোদা (সা.) নামাজের নূরের সাহায্যে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করলেন এবং ব্যাপক আধ্যাত্মিক অনুভূতি মনে লালন করে ব্যাপক আনন্দ ও খুশিপূর্ণ হৃদয়ে বাসায় ফিরলেন। যখন তাঁর স্ত্রী খাদিজা (রা.) কে দেখলেন, তাঁকে আল্লাহর ইবাদাত করার শ্রেষ্ঠ উপায় নামাজের সুসংবাদ দিলেন। খাদিজা (রা.) এর জন্যে সেই মুহূর্তটা যে কী রকম এক ঐশী আনন্দঘন ছিল, তা ভাষায় বর্ণনাতীত।
নবীজী এবং তাঁর স্ত্রী ওজু করলেন এবং দুই রাকাত নামাজ আদায় করলেন। কিছুক্ষণ পর আলী ইবনে আবি তালিবও এই পরিবারের সাথে একত্রে নামাজ পড়েন। তার পর থেকে এই তিন সর্বপ্রথম মুসলমান নামাজের সময় হলে জামাতে দাঁড়াতেন এবং আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ প্রেমপূর্ণ অন্তরে চমৎকার এই ইবাদাতটি জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালন করতেন।
গত আসরে আমরা বলেছিলাম যে, নামাজের উত্তম একটি দিক হলো ব্যক্তির অন্তরাত্মায় প্রশান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা। এ বিষয়টি ব্যক্তি মানুষের মানসিক ও আত্মিক সুস্থতা রক্ষার ব্যাপারে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। সুস্থতা এবং বাহ্যিক পবিত্রতা এমন একটি জিনিস যা নামাজের আদাব-কায়দার ভেতরে পরিলক্ষিত এবং পালিত হয়।
নামাজী ব্যক্তি যেহেতু তাঁর ইবাদাতের মাধ্যমে অনেক উপকৃত হন সেজন্যে পবিত্রতা এবং স্বাস্থ্যনীতি মেনে চলাটাকে নিজের দায়িত্ব বলে মনে করেন। তাই ওজু করার সময় দাঁত ব্রাশ করে দাঁতগুলোকে পরিস্কার এবং দুর্গন্ধমুক্ত করেন। কেননা রাসূলে খোদা (সা.) বলেছেন, মেসওয়াকের সহিত দুই রাকাত নামাজ পড়া মেসওয়াক করা ছাড়া সত্তুর রাকাত নামাজ পড়ার চেয়ে উত্তম।
নামাজ আদায়কারী নামাজের সময় চেষ্টা করেন সুগন্ধি আতর ব্যবহার করতে। কেননা ইমাম সাদেক (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, সুগন্ধি ব্যবহার করে যিনি নামাজ পড়েন, তার নামাজ সুগন্ধি ব্যবহারবিহীন সত্তুর জন নামাজীর নামাজ থেকে উত্তম।
সাধারণত আমরা যখন একদল নামাজিকে দেখবো যে সুশৃঙ্খলভাবে একত্রে নামাজে দাঁড়িয়েছে, নামাজের সৌন্দর্য, সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ানো, আল্লাহপন্থী এই মানুষগুলোর আধ্যাত্মিক সুষমা সবকিছুরই একটা ব্যতিক্রমধর্মী দীপ্তি রয়েছে। নামাজ আদায় করা এবং শিষ্টাচার চর্চা করা দুটোই একসাথে ঘটে।
নামাজের আগে প্রয়োজন হলো নামাজিকে প্রথমে অজু করতে হবে অর্থাৎ হাত-মুখ ধুতে হবে, পা ধুতে হবে অথবা মাসেহ করতে হবে, মাথা মাসেহ করতে হবে। এ সবই করতে হবে একটা নির্দিষ্ট নিয়মে। নামাজিকে অবশ্যই পবিত্রতা অর্জন করতে হয়।
শারীরিকভাবে পবিত্র হতে হয়, বাহ্যিকভাবে অর্থাৎ নামাজির জামা-কাপড় ইত্যাদিকে দূষণ থেকে পবিত্র হতে হয়, কেননা সৌন্দর্য আর পবিত্রতার উৎস মহান আল্লাহর দরবারে হাজির হন নামাজি। বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী নামাজে এইসব নিয়ম পালন আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথকে মসৃণতর করে এবং নামাজির তণু-মন-প্রাণ নিরাপদ ও প্রশান্ত হয়ে ওঠে।
একইভাবে যে স্থানে নামাজি নামাজ পড়তে দাঁড়ান সেই স্থান, যেই জামা-কাপড় তিনি পরেন সেগুলো এমনকি যেই পানি দিয়ে নামাজি অজু করেন সেই পানি-এ সবের কোনোটাই জবরদস্তিমূলক দখলকৃত হওয়া যাবে না। এই কারণে একজন নামাজি অন্যদের সম্পদ এবং অধিকার রক্ষা করাকে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে অনুভব করেন। কেননা তিনি জানেন যে নামাজের ভেতর মানুষের অধিকার লঙ্ঘন করা হয় সেই নামাজ আল্লাহর কাছে কবুল বা গ্রহণযোগ্য হবে না।
এভাবেই নামাজ মানুষের উদ্ধত আত্মাকে দূর করে দিয়ে শান্তশিষ্ট করে তোলে, অপরের অধিকার আদায় করতে শেখায় এবং ব্যক্তি এবং সমাজে নিরাপত্ত ও সুস্থতা নিশ্চিত করে। এজন্যে চরিত্র বিজ্ঞান মনে করে আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ককে সর্বোন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া এবং সংস্কার করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো বিশ্বের প্রতিপালকের সাথে পরিচয় করানো।
আর এই পরিছয় করানোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায়টি হলো নামাজ। নামাজের গঠনমূলক ভূমিকার প্রতি ইঙ্গিত করে রাসূলে খোদা (সা) বলেছেন, যথাসময়ে নামাজ পড়ার চেয়ে উত্তম আর নেই। আল্লাহর ফেরেশতা মানুষকে বলে হে মানুষ! উঠো! তোমার পিঠের ওপর নিজ হাতে যেই আগুন জ্বালিয়েছো, নামাজ পড়ার মাধ্যমে তা নেভাও!

Total Pageviews