মা ফাতিমার (আ.) শাহাদত ও আমাদের শিক্ষা

মা ফাতিমার (আ.) শাহাদত ও আমাদের শিক্ষাআহলে বাইত (আ.)এর প্রেমিকদের কাছে ১৩ই জামাদিউল আওয়াল থেকে ৩ জামাদিউসসানী মা ফাতেমার (ছা:) শাহাদত দিবস উপলক্ষ্যে বিশেষ শোকের দিন। কেননা কোন কোন রেওয়াতে বর্ণিত হয়েছে এগারোমহানবীর (স.)পরলোক গমনের পর মা ফাতেমা ৭৫ দিন জীবিত ছিলেন আবার কোন কোন বর্ণনায় ৯৫ দিনের কথা এসেছে আর এ জন্যই আহলে বাইত প্রেমিকগণ ১৩ই জামাদিউল আওয়াল থেকে ৩ জামাদিউস সানী বিশ দিন মা ফাতেমার (ছা:) শাহাদতদিবস উপলক্ষ্যে শোক পালন করে থাকেন।হযরত ফাতেমা (ছা:) ছিলেন বিশ্বের সকল মুমিন ও মোমেনার জননী কেননা মহানবী (স.) বলেছেন : আমি ও আলী এই মুসলিম উম্মতের পিতা। তাই নবী পত্নীগণ ও হযরত ফাতেমা (ছা.) মুসলিম উম্মাহর জননী। মা ফাতেমা (ছা.) পরকালে তাঁর অনুসারীদেরকে শাফায়াত করবেন এবং তিনি হলেন খাতুনে জান্নাত। হাদীসের এই কথাগুলোই আমাদের জাতিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নীচের কবিতায় ভেসে উঠেছে।বিশ্ব দুলালী নবী নন্দিনীখাতুনে জান্নাত ফাতেমা জননীমদিনা বাসিনি পাপও তাপও নাসিনীউম্মতও তারিনী আনন্দীনিবিশ্ব দুলালী নবী নন্দিনীখাতুনে জান্নাত ফাতেমা জননীসাহারা বুকে মাগো তুমি মেঘমায়াতপ্ত মরুরবুকে স্নেহতরূ ছায়ামুক্তি লভিল মাগো তব সুখও পরসেবিশ্বের জত নারী বন্দীনিবিশ্ব দুলালী নবী নন্দিনীখাতুনে জান্নাত ফাতেমা জননীঅতএব বিশ্বের সকল মুমিন ও মোমেনার জননী, শাহীদাহ্ যার জীবন ছিল অলৌকিকত্বে ভরপুর, সেই ঐশী নারীর পিতা সৃষ্টি জগতের শ্রেষ্ঠ অস্তিত্ব, যাঁর সন্তানদ্বয় ইমাম হাসান (আ.) ও ইমাম হোসেন (আ.) বেহেস্তবাসী যুবকদের র্সদার, যিনি নিজেই বেহেস্তবাসী নারীকুলের সম্রাজ্ঞী যাঁকে সৃষ্টি না করলে আল্লাহর রব্বুল আলামীন কোন কিছুই সৃষ্টি করতেন না। তাঁর শাহাদত ও ক্ষনিকের এ জীবনের মধ্যে আমাদের জন্য রয়েছে অনেক শিক্ষা । তাই আজ আমরা যদি মা ফাতেমার (আ.) জীবনী থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজ জীবন র্চচা করতে পারি তাহলে মহানবীর আর্দশের আলোতে আমাদের ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন ও সামাজিক জীবন হবে উঠবে আলোকিত । মা ফাতেমা (ছা.) এর শাহাদতেরমধ্যে যে গুপ্ত রহস্যগুলো লুকিয়ে রয়েছে যা ব্যক্তি, পারিবার ও সামাজ জীবনগঠনের মুলশক্তি হিসেবে পরিচিত আজ আমরা এখানে সেবিষয়সমূহ নিয়ে আলোচনা করবো।মা ফাতেমা (আ.) বিশ্ববাসীর কাছে একটি নিরব প্রশ্ন রেখে পৃথিবী থেকে বিদায়নিয়ে চলে গেছেন। যে প্রশ্নটির মধ্যেআমাদের প্রত্যেকের জন্যে অনেক শিক্ষার বিষয় রয়েছে। আর এ শিক্ষা যদি আমরা গ্রহণ করতে পারি তাহলে নিজের পরকালসহ আর্দশ সমাজ গড়ার শক্তি খুজেঁ পাব। আর যদি ব্যর্থ হই তাহলে ইতিহাসের দু:খজনক অধ্যায়ের পুর্নাবৃত্তির জাতায় নিষ্পেশিত হবেআমাদের জীবন ও জাতির ভবিষ্যত। ফলে আমাদের দুশমন ও ইবলিস শয়তানের রাজত্বের পরিধি বিস্তৃতি লাভ করবে এবং একই পথের পথিক মুমিনদের মধ্যে মতভেদ বৃদ্ধি পাবে।মুলত: প্রশ্ন হল মা ফাতেমাকে (ছালা:) এই অল্প বয়সে জীবন দিতে হল কেন ? কেন তাঁরা গৃহে হানা দেয়া হল ? কেন তিনি অসিয়াত করে গেলেন রাতের আধারেঁ ও গোপন স্থানে দাফন করতে ?!মহানবীর (স.) ঐশী মিশন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও সেযুগে যে শয়তানী চক্রান্ত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল তার প্রমাণ সুরা তওয়ার ১০১ নম্বর আয়াতে মহান প্রতিপালক ফাঁস করে দিয়েছেন । মহান আল্লাহ বলেন :ﻭَﻣِﻤَّﻦْ ﺣَﻮْﻟَﻜُﻢْ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﺄَﻋْﺮَﺍﺏِ ﻣُﻨَﺎﻓِﻘُﻮﻥَ ﻭَﻣِﻦْ ﺃَﻫْﻞِ ﺍﻟْﻤَﺪِﻳﻨَﺔِ ﻣَﺮَﺩُﻭﺍ ﻋَﻠَﻰ ﺍﻟﻨِّﻔَﺎﻕِ ﻟَﺎ ﺗَﻌْﻠَﻤُﻬُﻢْ ﻧَﺤْﻦُ ﻧَﻌْﻠَﻤُﻬُﻢْ ﺳَﻨُﻌَﺬِّﺑُﻬُﻢْ ﻣَﺮَّﺗَﻴْﻦِ ﺛُﻢَّ ﻳُﺮَﺩُّﻭﻥَ ﺇِﻟَﻰ ﻋَﺬَﺍﺏٍ ﻋَﻈِﻴﻢٍ“তোমাদের চারপাশে থাকা মরুবাসীদের (আরবদের) মধ্যকার একটি দল হচ্ছে মুনাফিক এবং মদীনাবাসীদের মধ্যেও অনেকে কপটতায় সিদ্ধ। তুমি তাদেরকে চেন না। আমি তাদেরকে চিনি। অচিরেই আমি তাদেরকে দুইবার শাস্তি দেব। পরেতাদেরকে আরও বড় শাস্তির জন্য ফিরিয়ে আনা হবে।”(৯:১০১)অতএব মহানবীর যুগ থেকেই একটি দল সুসংগঠিত ভাবে মহানবীর ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। যারা মহানবীর পরবর্তিকালে ইসলামের ইতিহাসে মহানবীর আর্দশকে ভুলেগিয়ে একেরপর এক মহাবির্পযায় ডেকে এনেছেন এবং বনি সাকীফার ঘটনা, মা ফাতেমার গৃহে আগুন দেয়ার ঘটনাসহ কারবালার ঘটনার মত অতিনিকৃষ্ট ঘটনাসমূহ ইতিহাসে সৃষ্টি করেছেন।যারা মা ফাতেমার সম্পত্তি বাগে ফাদাক ছিনিয়ে নিয়েছিল তাদের সকলের নেকাব তিনি উন্মোচন করে দিয়েগেছেন।সেই সত্য লুণ্ঠনকারীদেরকে মা ফাতেমা (আ.) তাঁর বিভিন্ন পদক্ষেপ ও ছোট একটি অসিয়াতের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট করে দিয়েগেছেন। তৎকালীন যুগের কপট ও ভন্ড নবীপ্রেমিক যারা গাদীরে খুমে রাসুলের অসিয়াতকে , মা ফাতিমার বাগে ফাদাককে, আহলে বাইতের (আ.) সম্মানকে পদতলে পিষ্ট করেছিল তাদের সকলের মুখোশকে টেনে ছিড়ে ফেলে দিয়েছেন। উন্মুক্ত করে দিয়েছেন তাদের নখরগুলোকে তারা যে কতখানি ভয়নক ও হিংস্র ছিল তা তিনি স্পষ্ট করে দিয়ে গেছেন। ইসলামী ইতিহাসের সেই লুকায়িত চরম সত্যকে মা ফাতিমা (আ.) আমাদের কাছে উন্মোচিত করে দিয়ে গেলেন তাঁর করুন শাহাদতের মধ্য দিয়ে।কিন্তু প্রশ্ন হল মদীনায় বসবাসকারী, এত মুসলামান থাকা সত্তেও কেন মা ফাতিমাকে (আ.) শহীদ হতে হল ?! কেন ইতিহাসের সর্বাধিক শক্তিশালী, জ্ঞানী, আবেদ মানুষের গলায় দঁড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়া হল ? কেন জনগণের পক্ষ থেকে আশানুরূপ কোন প্রতিবাদ আসেনি ?! কেন মা ফাতিমার (আ.)গৃহে যেখানে আল্লাহর ওহী নাযিল হয়েছিল সেখানে আগুন জ্বালা হল ?! জানি না আমার প্রশ্নগুলো আপনারা বুঝতে পেরেছেন কি না ? প্রকৃত পক্ষে মা ফাতিমাই (আ.) এপ্রশ্নগুলো আমাদের কাছে উত্তরের জন্যে রেখে গেছেন । তিনি চেয়েছেন তাঁর অনুসারীরা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বেঁর করবেন।নি:সন্দেহে আপনারা জানেন যখন মহানবীকে (স.)দাফন না করেই তথাকথিত সাহাবীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভাগাভাগী করতে বনি সাকিফাতে চলেগলেন তখনই মা ফাতিমা (আ.) মদীনায় প্রত্যেকের বাসায় বাসায় গিয়ে দরজায় কড়া নেড়ে ডেকে বলেছিলেন, তোমরা কি জান না গাদীরে খুমে আমার বাবা রাসুলুল্লাহ কি বলেছিলেন ? তোমরা কি জাননা আবুল হাসানকে তাঁর পরর্বতি উত্তসূরী মনোনীত করেগেছেন ? তোমরা কি জানেন না … আপনারা কি জানেন সেদিনসদ্য পিতা হারা মা ফাতিমাকে (আ.) তারাকি জবাব দিয়েছিলেন ?!ওহে উম্মে হাসান ! আমরা কিছু করতে পারবো না, তুমি দেরী করে ফেলেছো, এখন আমাদের আর কিছুই করার নেই ! তুমি ফিরেযাও নতুবা আমরা সমস্যায় পড়বো ! শুধু তাই নয় সেদিন মদীনাবাসী মা ফাতিমাকে(আ.) তাদের কাছে আসতে দেখে ঘরের দরজা , জানালা ঘট ঘট করে বন্ধ করে দিয়েছিল যাতে তাঁর করুণ ফরিয়াদ শুনতে না হয় ! মা ফাতিমার (আ.) কাঁন্নার আওয়াজ শুনে কেউই জিঙ্গাসা করতে আসেনি, যে কেন তিনি এত কাঁদছেন?! তারা জানতো এপ্রশ্নের উত্তর খুজতেই তিনি কাঁদছেন?! এ কান্না শুধু পিতা হারানোর কান্না নয় !এটা ছিল ইসলামের ভবিষ্যত ও রাসুলের অসিয়াত ভু-লুন্ঠিত হওয়ার আক্ষেপের কাঁন্না, আর এজন্য তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন একাধারে (এদৃশ্য দেখে) কেঁদে গেছেন ! এর মুল কারণ কি ? কেন ইসলামী ইতিহাসের প্রথম যুগেই এজাতিয় মহাবির্পযায় ঘটলো ?! কেন মহানবীর হাতে দীক্ষা লাভকারী মুসলমানরা হঠাৎ করে পিছুটান দিলেন ? কারবালার খুনে রাঙ্গা পথের সূচনা এখান থেকেই ঘটেছিল ! অন্যায়ের মোকাবিলায় দূর্বলঈমানদারদের নীরবতা জালিমের অপরাধেরপথকে সুগম করে দেয়। সেদিন যদি প্রতিবাদ করে অন্যায়কারীদের রূখে দিত তাহলে কারবালার তিক্ত ইতিহাস হয়ত রচিত হত না।আমরা যদি এর মুল কারণ গুলো চিহ্নিত করতে সক্ষম হই তাহলে মা ফাতিমার (আ.)অবস্থা সর্ম্পকে জানতে পারবো এবংরাসুলের আর্দশ রক্ষায় আমাদের দায়িত্ব কি তা পারবো চিহ্নিতি করতে সক্ষম হব।এই চরম হৃদয় বিদারক ঘটনার মুলে তিন শ্রেনী মানুষ অপরাধী। শুধু সেদিনই নয় যুগে যুগে এজাতিয় মানুষদের যথাসময়ে নিজ দায়িত্ব পালন না করার অপরাধের কারণে ধ্বংস হয়েছে বহুজনপদ হারাতে হয়েছে অসংখ্য মহাপুরুষকে, বিনষ্ট করা হয়েছে তাদের মুল্যবান জীবনের শত পরিশ্রম। অতএব এ বিষয়টি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ তাই সকলের মনোযোগ কামনা করছি।এজাতিয় ঘটনা সৃষ্টির মৌলিক কারণসমূহ :এক. প্রত্যেক সমাজে এমন কিছু মানুষ থাকেন যারা তাদের চোখের সামনে অন্যায় বা অপরাধমুলক কর্ম ঘটলেও তারা নিষ্ক্রিয় থাকেন। তাদের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে অপরাধীরা অন্যায় কাজের অনুপ্রেরণা পেয়ে থাকে। এলোকগুলো যথাসময়ে সঠিক ভুমিকা রাখলে কিন্তু অন্যায়কারীরা এতখানি উদ্ধ্যত হতে পারে না এবং তাদের নীল নকশা মাঠেই মারা যায়।কিন্তু সমাজে বিচক্ষণতার অভাব ও দুনিয়ার মোহ জনগণকে প্রতিরোধের পথে নিস্পৃহা করে দেয় ফলে তারা এক দিক থেকে ইসলামের একটি মুল ফরজ দায়িত্ব, সৎকাজের আদেশ ও অন্যায় কাজের নিষেধ পরিত্যাগ করেন আর অন্যদিকে সমাজে অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করলেন । মহান আল্লাহ এজাতিয় লোকদের প্রতি অভিশাপ দিয়েছেন:ﻟُﻌِﻦَ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻛَﻔَﺮُﻭﺍْ ﻣِﻦ ﺑَﻨِﻲ ﺇِﺳْﺮَﺍﺋِﻴﻞَ ﻋَﻠَﻰ ﻟِﺴَﺎﻥِ ﺩَﺍﻭُﻭﺩَ ﻭَﻋِﻴﺴَﻰ ﺍﺑْﻦِ ﻣَﺮْﻳَﻢَ ﺫَﻟِﻚَ ﺑِﻤَﺎ ﻋَﺼَﻮﺍ ﻭَّﻛَﺎﻧُﻮﺍْ ﻳَﻌْﺘَﺪُﻭﻥَবনী ইসরাঈলের মধ্যে যারা কুফরী করেছে তাদেরকে দাঊদ ও মারইয়াম পুত্রঈসার মুখে লা‘নত করা হয়েছে। তা এ কারণে যে, তারা অবাধ্য হয়েছে এবং তারা সীমালঙ্ঘন করত। ( সুরা মায়েদা- 78)

Total Pageviews